জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক আজ জোর দিয়ে বলেছেন, গত কয়েক দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পিত সংস্কার অবশ্যই টেকসই হতে হবে।
তিনি বাংলাদেশে তার দুই দিনের সরকারি সফর শেষ করার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এবার, অবশ্যই ন্যায়বিচার হতে হবে। সংস্কার অবশ্যই টেকসই ও স্থায়ী হতে হবে, যাতে গত কয়েক দশকের নিবর্তনমূলক অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’
তুর্ক মৌলিক পরিবর্তনের জন্য দেশের বর্তমান সুযোগের কথা তুলে ধরে বলেন, এ ধরনের পরিবর্তন মানবাধিকার সমুন্নত রেখে শাসন, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে একটি নতুন পথ রচনা করতে পারে।
তিনি বিভাজন, বৈষম্য ও দায়মুক্তি অবসানের লক্ষ্যে একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের জন্য সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত উচ্চ প্রত্যাশাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, ‘বৈষম্য, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার চক্র, প্রান্তিকীকরণ, দুর্নীতি ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে অবশ্যই অতীতে ছুঁড়ে ফেলতে হবে।’
এসব নজির ভাঙার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে হাইকমিশনার এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে তার দপ্তরের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে বলেন, ‘এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সফল করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর সবকিছু করতে প্রস্তুত রয়েছে।’
তিনি মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে স্বাগত জানান।
তুর্ক প্রধান উপদেষ্টার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের গুরুত্ব উল্লেখ করেন।
তিনি বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, সাংবিধানিক বিষয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করার লক্ষ্যে দ্রুত বিভিন্ন কমিশন গঠনের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম অধিকার ও নারী বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য আরো কমিশন গঠন করা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ‘আজকে বেশ কয়েকজন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনায় আমরা আস্থা-নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিকরণের গুরুত্ব এবং একই ধরনের সমস্যা-আক্রান্ত অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি।'
তিনি বলেন, এসব সংস্কার বাংলাদেশে কয়েক দশকের তীব্র রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে আনার এবং দলীয়করণের রাজনীতি পরিহারের জন্য একটি জোরালো পদক্ষেপ হতে পারে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই ও আগস্টে নিহত ও গুরুতর আহত বিক্ষোভকারী এবং শিশুসহ অন্য মানুষের ওপর নৃশংস সহিংসতার বিচারের প্রয়াস অগ্রাধিকার পেতে হবে।’
ফলকার তুর্ক বাংলাদেশে সকল হত্যাকাণ্ডের তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সমাবেশের ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা হত্যাকাণ্ড ঘটতে দিতে পারি না।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সদস্য বা সমর্থকসহ কারো বিরুদ্ধে কেবল তাদের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সমীচীন নয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান সতর্ক করে বলেন, বহু সাংবাদিকের নামেসহ বেশ কিছু হত্যার অভিযোগ যথাযথ তদন্তের ভিত্তিতে না হওয়ার কারণে উদ্বেগ রয়েছে। ‘অতীতের দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি না করা গুরুত্বপূর্ণ।’
‘বিপুল সংখ্যক মিথ্যা মামলা দায়ের করার বিষয়টি মোকাবিলা করার হাতিয়ার হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়ে তুর্ক বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।’
তুর্ক বলেন, ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাড়াঘড়ি করে যাতে অভিযোগ আনা না হয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)সহ সকল পর্যায়ে যথাযথ প্রক্রিয়া ও সুবিচারের মানদণ্ড বজায় রাখা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারকে অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়ার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন দেখতে পেয়েছি।’